মৌলিক বল
মৌলিক শব্দের অর্থ বলতে সাধারণত বোঝায় স্বাধীন এবং অনন্য বা নিরপেক্ষ । খুব সাধারণভাবে যদি বলা হয়,
মৌলিক বল হচ্ছে মূল বা স্বাধীন বল অর্থ্যাৎ যে সকল বল অন্য কোন বল থেকে উৎপন্ন হয় না বা অন্য কোন বলের রূপ নয় বরং অন্যান্য সকল বল এর থেকে উৎপন্ন হয় কিংবা এসব বলের রূপান্তর মাত্র তাদেরকে মৌলিক বল বলে । প্রকৃতিতে বিদ্যমান চারটি মৌলিক
বলকে দুর্বলতার অনুক্রমে সাজালে আমরা পাই-
1.
মহাকর্ষ বল ।
2.
দুর্বল নিউক্লিয় বল ।
3.
তড়িৎ চৌম্বক বল ।
4.
সবল নিউক্লিয় বল ।
মহাকর্ষ বলঃ
মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে তাদের মধ্যকার এ আকর্ষণ বলকে বলা হয় মহাকর্ষ বল । আইজাক
নিউটন ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা
গ্রন্থে এ বিষয়ে ধারণা প্রদান করেন । তিনিই সর্বপ্রথম মহাকর্ষ বলের গাণিতিক
ব্যাখ্যা প্রদান করেন যা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র নামে পরিচিত । তবে আধুনিক পদার্থবিদ্যায়
মহাকর্ষ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব দ্বারা বর্ণনা করা হয় । আইনস্টাইনের
মতে স্থান-কালের বক্রতার কারণেই মহাকর্ষ
বল সৃষ্টি হয় । তবে
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুইটি বস্তুর মধ্যে গ্রাভিটন নামক একটি কণার পারস্পরিক
বিনিময়ের মাধ্যমেই এই বল কাজ করে । এই আকর্ষণ বলটি নিউটন শুধু আবিষ্কারই করেননি, সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন সৌরজগতের নিয়ম প্রতিষ্ঠায় । নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটি হলো: “এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে আকর্ষণ করে, এই আকর্ষণবলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরের গুণ ফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যবর্তী দুরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এই বল এদের কেন্দ্রের সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়াকরে” ।
তড়িৎ চৌম্বক বলঃ
দুইটি আহিত বা চার্জিত বস্তুর মধ্যে কিংবা দুইটি চৌম্বক পদার্থের মধ্যে এক
ধরণের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে যাকে বলা হয় তড়িৎ চুম্বকীয় বল । এদিকে এই বলের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি পরমাণু বা একটি অণু স্থিতিশীলতা পায় । রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য দায়ী এই বল । কুলম্ব, ফ্যারাডে, আম্পিয়র প্রমূখ বিজ্ঞানী ও তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের কাজের মধ্য দিয়ে তাড়িত চৌম্বক বলের প্রকৃতি উদ্ঘাটিত হয় । ম্যাক্সওয়েল এই বলের প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ গাণিতিক মডেলের ওপর স্থাপন করে এর পরিপূর্ণতা প্রদান করেন । ম্যাক্সওয়েলই সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ, চুম্বক ও আলোক শক্তিকে একটি একক সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন । অর্থাৎ তড়িৎ ও চুম্বক দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলেও
এদেরকে এক সাথে আলোচনা করা হয়, কারণ এদের একটি হতে অন্যটি উৎপন্ন হতে পারে । তড়িৎ
আধান বা চার্জ গতিশীল হলে তারা চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে । আবার পরিবর্তনশীল
চৌম্বকক্ষেত্র তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করে । এই বলের কার্যকর সীমা অসীম, বলের বাহক হলো শূন্য-স্থিরভর বিশিষ্টফোটন কণিকা । তাড়িত চৌম্বক বল প্রভাবিত বিক্রিয়া প্যারিটি প্রতিসাম্য মেনেচলে । তড়িত-চুম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে মেসেঞ্জার পার্টিকেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ফোটন নামক ভরহীন,স্পিন ১(যাদেরকে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরালে দেখতেআগের মত লাগবে । যেমনঃ তাসের একটি টেক্কা) বিশিষ্ট কল্পিত এক কণা । আর ভরহীন কণারদ্বারা এ বল বাহিত হওয়ার কারণে এর পাল্লাও অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত ।
দুর্বল নিউক্লিয় বলঃ
আমারা জানি প্রকৃতিতে কিছু মৌলিক কণিকা আছে
(পারমাণবিক ভর 82 এর চেয়ে বেশি) যাদের নিউক্লিয়াস স্বতস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে যায় । যা তেজস্ক্রিয়তা নামে পরিচিত এবং এ সকল নিউক্লিয়াসদেরকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস । ভাঙ্গনের সময় এ সকল নিউক্লিয়াস কিছু রশ্মি বিকিরণ করে যারা তেজস্ক্রিয় রশ্মি নামে পরিচিত । ১৮৯৯ সালে রাদারফোর্ড এবং ভিলার্ড বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে বলেন যে, এরা হল ধনাত্বক চার্জ বিশিষ্ট আলফা,
ঋনাত্বকচার্জ বিশিষ্ট বিটা এবং চার্জহীন গামা । তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যখন বিটা কণা নির্গত হয় তখন কিছু পরিমাণ শক্তিও নির্গত হয় যা কিনা বিটা কণার কণার গতিশক্তি অপেক্ষা সামান্য বেশি । এখন প্রশ্ন আসে যদি বিটা কণা এ শক্তির সামান্য অংশ বহন করে থাকে তবে বাকি শক্তির উৎস কি ? ১৯৩০ সালে ডব্লিউ পাউলি প্রস্তাব করেন যে অবশিষ্ট শক্তি বহন করে আরেক ধরণের কণিকা যা কিনাবিটা কণার সাথেই নির্গত হয় । এই কণাকে বলা হয় নিউট্রিনো । এই বিটা কণা এবং নিউট্রিনো কণার ফলেই সৃষ্টি হয় দূর্বল নিউক্লীয় বলের । একটা উদাহরণ দেখা যাক,
একটি সিজিয়াম পরমাণুতে মোট নিউক্লীয়ন সংখ্যা ১৩৭ । অর্থাৎ এতে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা ১৩৭ । সিজিয়ামে মোট প্রোটন সংখ্যা হল ৫৫টি । এখন যদি “কোনোভাবে” একটি নিউট্রন একটি প্রোটনে পরিণত হতে পারে তবে মোট নিউক্লীয়ন সংখ্যার কোনো পরবর্তন না হলেও যেহেতু একটি প্রোটন বেড়ে গিয়ে ৫৬টি হয়ে যাচ্ছে ফলে পরমাণুটি আর সিজিয়াম পরমাণু থাকবে না । তখন এটি হয়ে যাবে ৫৬ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট বেরিয়াম পরমাণু । আর এই জন্য যাকে দায়ী করা হয় তার নামই দূর্বল নিউক্লীয় বল । এই পরিবর্তন বা ভাঙ্গনের সময় একটি ইলেকট্রনের পাশাপাশি একটি ইলেকট্রন এন্টি-নিউট্রিনো নির্গত হবে । তবে মজার ব্যাপার হল এই দূর্বল বলকে বুঝতে বেশ সময় লাগে বিজ্ঞানীদের ।
সবল নিউক্লিয় বলঃ
আমরা জানি, একটি পরমাণু কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস চার্জধারী কনিকা প্রোটন ও চার্জ নিরপেক্ষ কণিকা নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত । নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে প্রোটন ও নিউট্রন সমূহকে যে বল ধরে রেখে নিউক্লিয়াস টিকে স্থিতিশীলতা দান করে সেই প্রকৃতির বলই সবল নিউক্লিয় বল নামে অভিহিত । এটি প্রকৃতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং
চার্জ অনপেক্ষ । অর্থ্যাৎ প্রোটন প্রোটনের মধ্যে, নিউট্রন নিউট্রনের মধ্যে আবার প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে সমভাবে ক্রিয়াশীল । এটির কার্যকারিতা অতি স্বল্প দূরত্ব প্রসারী মাত্র ফার্মি(10-15) সীমার দূরত্বের মধ্যে ।
এটি মূলত আকর্ষণ ধর্মী হলেও একটি বিশেষ দূরত্বের কমে বিকর্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে । এর প্রয়োজন দেখা দেয় নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে ।
বলের একীভূতকরণঃ
ম্যাক্সওয়েল অনেক আগেই বৈদ্যুতিক এবং চুম্ব্বকীয় বলকে একসাথে করলেও তার প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৬১ সালে শেলডন গ্ল্যাশো তড়িত-চুম্বকীয় এবং দূর্বল নিউক্লীয় বলকে একীভূত করার জন্য একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন । তবে এটি ছিল অসম্পূর্ণ। পরবর্তীতে সালাম এবং ওয়েইনবার্গ নামক দু’জন বিজ্ঞানী এ তত্ত্বের পূর্ণতা প্রদান করেন যা কিনা
“Electroweak Interaction নামে পরিচিতি লাভ করে ।
মৌলিক বলগুলোর শক্তিমাত্রাঃ
সবল নিউক্লিয় বলের শক্তিমাত্রাকে যদি 1 ধরা হয় তবে আপেক্ষিক শক্তিমাত্রার মাপে বলগুলোকে ওপর থেকে নিচে এভাবে সাজানো যায়-
বল
|
আপেক্ষিক শক্তিমাত্রা
|
মেসেঞ্জার পার্টিকেল
|
সবল নিউক্লিয় বল
|
1
|
গ্রাভিটন
|
তাড়িৎ চৌম্বকিয় বল
|
10-2
|
ফোটন
|
দুর্বল নিউক্লিয় বল
|
10-12
|
বোসন
|
মহাকর্ষ বল
|
10-39
|
গ্লুয়োন
|
0 মন্তব্যসমূহ