গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে প্লুটোকে (Pluto)

আবিষ্কারের পর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানুষ একে গ্রহ হিসেবেই চিনেছেকিন্তু ২০০৬ সালের ২৪ শে আগষ্ট ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়ন  ঘোষণা দেয় যে,গ্রহ হবার জন্য যে যে যোগ্যতা থাকা দরকার প্লুটোর মাঝে তা নেই সেজন্য প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে এরপর লাগলো ঝামেলা সারা দেশে কেন বাপু? নিজেরা নিজেরা যোগ্যতার মাপকাঠি বানিয়ে নিজেরা নিজেরাই প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য কী ? শুরু হলো আন্দোলন ।  রীতিমতো ব্যানার,ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে মানুষ আন্দোলনকারীদের দাবি প্লুটোকে আবারও সুযোগ দেওয়া হোক প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার জন্য এমনকি আন্দোলন ও করেছে মানুষেরা ।
ছবিঃ প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা দেয়ার জন্য আন্দোলনকারীরা । 
আবিষ্কারের আগে থেকেই প্লুটোর জীবন বেশ ঘটনাবহুল সৌরজগতের অন্যান্য যেকোনো অন্য গ্রহের তুলনায় এটি অনন্য প্লুটোর ঘটনাবহুল জীবন এখানে তুলে ধরেছি
আবিষ্কারের ইতিহাস
বিজ্ঞানী ও গণিতবিদরা একটি দিক থেকে অনন্য কোনো বস্তকে সরাসরি না দেখেও গাণিতিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারেন তারা সাধারণত গ্রহদের গতিপথ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তার আশেপাশে কোন গ্রহ উপগ্রহ আছে কিনা তা বলতে পারেন যেমন বিজ্ঞানীরা একবার হিসেব করে দেখলেন মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতিগ্রহের মাঝে একটি গ্রহ থাকার কথাকিন্তু কোনো কারণে গ্রহটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না পরবর্তীতে আবিস্কৃত হলো এখানে ঠিকই একটি গ্রহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল,কিন্তু কোনো কারণে সেটা সম্পন্ন হতে পারে নি যে যে গ্রহের সমন্বয়ে গ্রহটি গঠিত  হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝের অঞ্চল জুড়ে এই অঞ্চলের বস্তু গুলোকে আমরা গ্রহাণুপুঞ্জ বলে জানি অর্থাৎ গ্রহাণুপুঞ্জ হল,এরা একত্রে একটি গ্রহ গঠন করার কথা ছিল

ছবি: থিংলিংক
১৮৪৬ সালের দিকে নেপচুন গ্রহ আবিষ্কৃত হয় নেপচুনের আগের গ্রহ ইউরেনাস ইউরেনাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ  করে সেখানে কিছু অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করেন পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের মাধ্যমে সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন এর বাইরে আর একটি গ্রহ থাকতে পারে সেই গ্রহটি হচ্ছে নেপচুনপরবর্তীতে নেপচুনের গতিপথেও কিছু অসামঞ্জস্য খুঁজে পায় বিজ্ঞানীরা ধরে নেয় এর বাইরে কোনো একটি গ্রহ আছে যেটি তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে নেপচুনের গতিপথকে প্রভাবিত করছে
কিন্তু কোথায় সেই গ্রহ ? দিনের পর দিন খোঁজা হয়, কিন্তু ধরা দেয় না বিজ্ঞানীরা এর নাম দিলেন প্লানেট এক্স'বা অজানা গ্রহ । গ্রহ খোঁজার জন্য যিনি অত্যান্ত গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নামেন তাঁর নাম হচ্ছে পার্সিভাল লোভেল খুব সম্পদশালী ছিলেন অনেক অর্থ ব্যয় করে আরিজোনায় লোভেল অবজারভেটরি' নামে একটি মানমন্দির তৈরি করেন ১৮৯৪ সালে সম্ভাব্য গ্রহটি খুঁজে পাওয়া জন্য ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেন সেখানে
কিন্তু বিধি বাম অনেক দিন খোঁজাখুঁজির পরেও সেই গ্রহ টি খুঁজে পাওয়া যায় নি ১৯১৬ সালে পার্সিভালের মৃত্যুর পর্যন্ত বিশেষ এই গ্রহ অনুসন্ধানের কাজ অব্যাহত চলছিল তার মৃত্যুর পর এই কাজে ভাটা পরে যায় ।  

ছবিঃ পার্সিভাল লোভেল,প্লুটোর আবিস্কারের পেছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল
অনেক দিন পর একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এই কাজকে বেগমান করে লোভেল অবজারভেটরির পরিচালকের কাছে একদিন আকাশপটের চিত্র সম্বলিত একটি চিঠি আসে চিঠিটি পাঠিয়েছেন একজন তরুণ,যার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো লেখাপড়া নেই বেশি লেখাপড়া করতে পারে নি এমন তরুণের আকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাকে ডেকে এনে একটি চাকুরী দিয়ে দেন চাকুরীতে কাজ হলো আকাশের ছবি তুলে তুলে প্লুটো গ্রহকে অনুসন্ধান করা তরুণের নাম ক্লাইড টমবো (Clyde Tombaugh) কেন এবং কিভাবে এখানে চিঠি পাঠালো সে গল্প ও বেশ ঘটনা বহুল ছোটবেলা থেকেই টমবোর জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ ছিল এর জন্য পরিবেশও পেয়েছিল ইতিবাচক চাচার একটি টেলিস্কোপ ছিলো সেটি দিয়ে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন এক সময় নিজেই টেলিস্কোপ তৈরি করার কৌশল রপ্ত করে নিলেন ১৯২৮ সালে একটি ৯ ইঞ্চি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরি করেন এর আগে বানানো টেলিস্কোপ গুলো এতোটা নিখুঁত ছিল না সে তুলনায় এটি বেশ নিখুঁত হয়েছে আকাশপট দেখাও যায় পরিষ্কার সে বছর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার কথা ছিল সাবজেক্ট ও ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান কিন্তু ভাগ্য ইতিবাচক ছিল না তার এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিলাবৃষ্টিতে পরিবারের সকল ফসল ধ্বংস হয়ে গেল এখনকার আমেরিকা আর তখনকার আমেরিকার মাঝে বিস্তর পার্থক্য সে সময় সকল ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে না অনাহারে মরে যাওয়াএমন অবস্থায় তার পরিবারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগানো সম্ভব ছিলনা মন খারাপ করে তিনি থেকে রইলেন সেখানে এবং কৃষি কাজে মন দিয়ে পরিবারের উন্নয়ন করার কাজে মনঃস্থ হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারেন নি তো কি হয়েছে,আকাশ প্রেমী মনটা তখনো রয়ে গিয়েছিল কাজ শেষ করে রাতের বেলায় টেলিস্কোপ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আকাশে শখের বসেই পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গ্রহ দুটির নিখুঁত চিত্র একে সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন লোভেল অবজারভেটরিতে অবজারভেটরির পরিচালক তার প্রতিভা ধরতে পারেন এবং ডেকে এনে আকাশ পর্যবেক্ষণ করার চাকুরিতে বসিয়ে দেন  

ক্লাইড টমবো,তিনিই প্লুটো গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন ছবি : দ্যা টেলিগ্রাফ
কোনো মানুষ যখন তার শখের ও পছন্দের কাজটি চাকুরী হিসেবে পায় তখন কাজটি দেখতে তখন যত কঠিনই মনে হোক না কেন তার কাছে সেটি আনন্দদায়ক টমবোর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য কারণ সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে এমন কোনো গ্রহ কে খুঁজে বের করা সহজ কথা নয় আকাশের সম্ভাব্য যে যে অবস্থানে গ্রহটি থাকার কথা সে অংশগুলোর ছবি তুলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে তা বের করা মনে হতে পারে এ আর এমন কঠিন কি ? ছবি তোলাই তো কিন্তু যখন দেখা যাবে আকাশের ঐ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বিন্দু ধরে ছবি তুলতে হবে তখন অবশ্যই সেটি কঠিন কাজের মাঝে পড়ে পরিশ্রম সাধ্য কাজ হলেও টমবো আনন্দের সাথেই তা করতে থাকে ১৯৩০ সালের দিকে তিনি তার পরিশ্রমের ফল পেলেন আকাশের একটা অংশে এমন একটা বিন্দুর দেখা পেলেন যেটি তার অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে এটিই নতুন গ্রহ প্লুটো গ্রহ আবিষ্কারের খবর যখন প্রকাশ করা হল তখন সারা দেশে মোটামুটি একটা আলোড়ন পড়ে গেল ২৩ বা ২৪ বছরের এক তরুণ আস্ত একটি গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছে এই খবরে সারাদেশে তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্কলারশিপ প্রদানের মাধ্যমে লেখাপড়ারও সুযোগ করে দিলো

১৯৩০ সালের জানুয়ারির ২৩ ও ৩০ তারিখে প্লুটোর অবস্থান এই ছবি থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল প্লুটো গ্রহছবি: ভিন্টেজ স্পেস
নামকরণ
পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গেছে প্লুটো গ্রহের আবিষ্কার শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে গেছে এর আমেজ নতুন গ্রহটির তো একটা নাম দেয়া দরকার সে উদ্দেশ্যে নাম আহ্বান করা হলে প্রায় এক হাজারের চেয়েও বেশি নাম জমা হয়অনেক নাম আসে তাদের হাতে সবগুলো নাম যাচাই বাছাই করে এগারো বছর বয়সী এক স্কুল বালিকার নাম গ্রহণ করা হয় তার প্রস্তাবিত নাম ছিল প্লুটো কারণ চিরায়ত পুরাণে প্লুটো হচ্ছে  Underworld বা অন্ধকার রাজ্যের দেবতা অন্যদিকে প্লুটোও সবসময় অন্ধকারে থাকে সূর্য থেকে এত দূরে এর অবস্থান যে সেখানে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছায় না বললেই চলে সে হিসেবে নামকরণ সার্থক

ভেনেটিয়া বার্নে,তিনি এগারো বছর বয়সে প্লুটো গ্রহের নামকরণ করেছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন
ছবি :উইকিমিডিয়া কমন্স
ভেনেটিয়া নামক স্কুল বালকটির ছোটবেলা থেকেই পৌরাণিক গল্পের প্রতি আগ্রহ ছিল তার দাদা ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান দাদার সাথে কথা বলেই তিনি নামটি প্রস্তাব করেছিলেন
কেন প্লুটো গ্রহের তালিকার বাইরে
গ্রহটি আবিষ্কারের পর ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথ সংক্রান্ত সমস্যার হয়তো সমাধান হয়েছে, কিন্তু সাথে সাথে আরও অনেকগুলো নতুন সমস্যার জন্মও হয়েছে যেমন এটি আকারে অনেক ছোট এর ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৫ ভাগের এক ভাগ ভরও অনেক কম,পৃথিবীর ভরের ৫০০ ভাগের এক ভাগ এর কক্ষপথ ও স্বাভাবিক নয়,সূর্যের চারপাশে আবর্তনের এক পর্যায়ে নেপচুনের কক্ষপথ ভেদ করে ভেতরে চলে আসে সৌরজগতের বাইরের দিকের গ্রহগুলো গ্যাসীয়, কিন্তু এটি পাথুরে অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি একটি সমতলে অবস্থান করছে কিন্তু এর কক্ষপথ কিছুটা হেলে আছে এর মাঝে প্লুটোর একটি উপগ্রহও আবিষ্কৃত হয় সাধারণত কোনো গ্রহের উপগ্রহ গুলো অনেক ছোট হয় এবং গ্রহের শক্তিশালী আকর্ষনের প্রভাবে এরা গ্রহের চারপাশে ঘুরে কিন্তু প্লুটোর বেলায় হয়েছে অন্যটা প্লুটোর উপগ্রহটি প্লুটোর আকারের প্রায় অর্ধেক, যা উপগ্রহ হিসেবে তুলনামূলক ভাবে অনেক বড় উপগ্রহ যদি আকারের দিক থেকে গ্রহের আকারের অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে তো সেটি গ্রহের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাবে আকারে বড় হওয়ার কারণে অবাধ্য আচরণ করবে মূল গ্রহের প্রভাব না মেনে নিজেই একটা প্রভাব তৈরি করতে চাইবে এমন হয়ে থাকলে সেটা গ্রহের মান সম্মানকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিবে

প্লুটো এবং তার উপগ্রহ ক্যারন এরা উভয়ে উভয়ের আকর্ষণ দ্বারা প্রভাবিত ছবি:ডেইলি গ্যালাক্সি
প্লুটোর গ্রহত্ব নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় ২০০৫ সালে বিজ্ঞানীরা প্লুটোর সীমানার বাইরে একটি বস্তুর দেখা পান,যার ভর প্লুটোর ভরের চেয়েও বেশি এর নাম রাখা হয় এরিস আবিষ্কারের পরপর নাসা কতৃপক্ষ একে দশম গ্রহ হিসেবে ঘোষণা দেয় কিন্তু পরবর্তীতে ঐ এলাকায় এরকম আরও কিছু বস্তু খুঁজে পাওয়াতে গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় বস্তুদেরকে এভাবে গণহারে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে ঐ কক্ষপথের আশেপাশে অনেক গুলো গ্রহ হয়ে যাবে, যা শুধু ঝামেলাই বাড়াবে এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়ে যান এবং সম্মেলনের মাধ্যমে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়ন (IAU) এর এই সম্মেলনে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় এখানে প্রথমে বিজ্ঞানীদের নিয়ে ভোটাভুটি করা হয় একটি অপারেশন হচ্ছে এরিস ও সেরেস ( সবচেয়ে বড় গ্রহাণু)  সব গ্রহ হবে মোট বারোটি প্লুটোও থাকবে গ্রহের তালিকায় যেহেতু তাদের ভর প্লুটোর চেয়ে বেশি বা প্লুটোর কাছাকাছি তাই প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে তাদেরকে কেন নেয়া হবে না ? আরেকটি অপারেশন হচ্ছে সৌরজগতের যে যে বস্তু গুলো বেশি পরিচিত সেগুলো গ্রহের পরিচয় পাবে তাহলে প্লুটো সহ মোট গ্রহ হবে ৯ টি প্লুটোর চেয়েও ভারী অন্যান্য বস্তু দুটি তালিকা থেকে বাদ যাবে এই সংজ্ঞা অবশ্যই যুক্তিসজ্ঞত নয় তৃতীয় অপারেশন হচ্ছে যৌক্তিক সংজ্ঞার ভেতরে পড়লে কোনো বস্তু গ্রহ বলে বিবেচিত হবে এর বাইরে হলে নয় এই হিসেবে মোট গ্রহ হবে ৮টি প্লুটো যাবে বাদ সাধারণ গ্রহাণু থেকে বড় কিন্তু স্বাভাবিক গ্রহ থেকে ছোট,  এ ধরনের বস্তুর জন্য বামন গ্রহ  নামে আলাদা একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় সেই হিসেবে প্লুটো, সেরেস,এরিস বামন গ্রহ হিসেবে বিবেচ্য হবে

২০০৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়নের  সাধারণ সম্মেলনএখানে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় ছবি :IAU
ভোটাভুটিতে বিজ্ঞানীরা শেষোক্তটিকেই বেচে নিলেন গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটো বাদ এই সম্মেলন যদি সাধারণ মানুষদের নিয়ে করা হতো তাহলে তারা আবেগকেই প্রাধান্য দিতো বেশি কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিয়ে করাতে সেখানে যৌক্তিক অবস্থানটি জয়ী হয়েছে
গ্রহ হবার শর্ত
ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়ন কতৃক নির্ধারিত গ্রহ হবার শর্ত গুলো হচ্ছে
1.     সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে (প্লুটো এই শর্তে উত্তীর্ণ) ।
2.     যথেষ্ট ভর থাকতে হবে যেন তার অভিকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে নিজেকে মোটামুটি গোলাকার আকৃতি ধারণ করতে পারে । (প্লুটো এই শর্তে অনুত্তীর্ণ) ।
3.     কক্ষপথে ঘোরার সময় তার আসেপাশে শক্তিশালী প্রভাব রাখতে হবে যেন আসেপাশের জঞ্জাল বস্তুগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে । (এখানেও প্লুটো অনুত্তীর্ণ) ।
শেষ দুই শর্ত পূরণ করতে পারে নি বলে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে খেয়াল করলে দেখা যাবে সকল গ্রহই গোল হয় কোনো গ্রহই পিরামিড, সিলিন্ডার কিংবা ঘনকের মতো হয় না বস্তু যখন খুব বেশি ভারী হয়ে যায়, তখন তার আকর্ষণের শক্তির তুলনায় গ্রহের উপাদান গুলো প্রবাহী বা ফ্লুইডের মতো হয়ে যায় স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর গাঠনিক উপাদানকে কঠিন পদার্থ বলে মনে হলেও পৃথিবীর শক্তিশালী আকর্ষণ সেগুলোকে স্থানচ্যুত করতে পারে প্রকৃতির সকল বস্তুর ধর্মই হচ্ছে গোলাকৃতি ধারণ করা মগ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিলে দেখা যাবে সেই পানি অনেকগুলো গোলাকার ফোটা তৈরি করেছে যাকে বলা হয় পৃষ্টটান । গ্রহগুলোও এই ধর্মের জন্য গোলাকৃতি ধারণ করে কিন্তু প্লুটোর মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ ভর নেই যা দিয়ে নিজের গাঠনিক উপাদানকে নেড়েচেড়ে অন্য যেকোনো আকৃতি থেকে পালটে গোলাকৃতি ধারণ করতে পারবে অন্যান্য গ্রহ যখন তাদের কক্ষপথে ঘোরে তখন মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে আশেপাশের ক্ষুদ্র বস্তু গুলোকে নিজের দিকে টেনে নেয় ফলে কক্ষপথ হয়ে যায় জঞ্জাল মুক্ত প্লুটো এই কাজটি করতে পারেনি যথেষ্ট শক্তিশালী প্রভাব নেই বলে তার কক্ষপথের আশেপাশে জঞ্জাল রয়েই গেছে  এতসব দিক বিবেচনা করে প্লুটোকে সতর্কতার সাথেই গ্রহের তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে ছোটবেলায় আমরা বই পুস্তকে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে পড়েছিলাম এখন পড়তে হবে প্লুটো একটি বামন গ্রহ মাত্র
মন খারাপের গল্প
এতদিনের প্রতিষ্ঠিত ও এতো চমৎকার নামধারী একটি গ্রহের গ্রহত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে -এটা মানতে পারেনি আমেরিকার মানুষজন এদের দাবী হচ্ছে -আকৃতি কোনো ব্যাপার না, সারা জীবন একে আমরা গ্রহ হিসেবে জেনে এসেছি তাই একে গ্রহের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া হোক কেউ কেউ বলেছে -সকল আকৃতি, সকল আকার এবং সকল ধরণের কক্ষপথকেই আমরা সাপোর্ট করি তাই প্লুটো যে অবস্থানেই  থাকুক না কেন তাকে গ্রহের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হোক আবার কেউ কেউ পোস্টারে লিখেছে এখন প্লুটোকে সরানো হয়েছে, আপনাদের পরবর্তী টার্গেট কি নেপচুন আর ইউরেনাস কে সরানো ?
সাধারণত বিজ্ঞান সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোর দাবিদাওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করা যায় না আমেরিকানরা এটাই করেছে বাংলাদেশেও এমন হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়েরযেন ফাঁসি না হয় সেজন্য মিছিলে নেমেছিল মানুষ এধরণের ব্যাপারগুলো আবেগের নারী ধরে টান দেয়,তাই হয়তোবা মানুষজন আবেগের বশবর্তী হয়ে নেমে যায় রাস্তায়  বিজ্ঞানের ধর্মই হচ্ছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলা যৌক্তিক পরিবর্তনকে মেনে নেওয়াই হচ্ছে সত্যিকার বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক দীর্ঘদিন ধরে কোনোকিছুকে বিশেষ পরিচয়ে চিনলে তার প্রতি মায়া তৈরি হবেই এই পরিচয়ে পরিবর্তন আসলে মায়া এবং আবেগে টান দেবেই কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে আবেগ এবং মায়াকে বাক্সবন্দী করে পরিবর্তন কে মেনে নিতে হবে প্লুটোর এ গল্প আমাদেরকে এটাই শিক্ষা দেয় ।
তথ্যসূত্রঃ
1.    আরো একটুখানি বিজ্ঞান, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কাকনি প্রকাশনী ।
2.    মহাকাশের কথা, ফারসীম মান্নান মোহাম্মাদী, অনুপম প্রকাশনী ।
3.    Universetoday.com
4.    Vintagespace.wordpress.com
5.    Wikipedia.org

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ