ছবিঃ প্লুটোকে গ্রহের মর্যাদা দেয়ার জন্য আন্দোলনকারীরা ।
আবিষ্কারের আগে থেকেই প্লুটোর জীবন বেশ ঘটনাবহুল । সৌরজগতের অন্যান্য যেকোনো অন্য গ্রহের তুলনায়
এটি অনন্য । প্লুটোর
ঘটনাবহুল জীবন এখানে তুলে ধরেছি ।
আবিষ্কারের ইতিহাস
বিজ্ঞানী ও গণিতবিদরা একটি দিক থেকে অনন্য । কোনো বস্তকে সরাসরি না দেখেও গাণিতিক হিসাব নিকাশের
মাধ্যমে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারেন তারা । সাধারণত গ্রহদের গতিপথ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে তার
আশেপাশে কোন গ্রহ উপগ্রহ আছে কিনা তা বলতে পারেন । যেমন – বিজ্ঞানীরা
একবার হিসেব করে দেখলেন মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতিগ্রহের মাঝে একটি গ্রহ থাকার কথা। কিন্তু কোনো কারণে গ্রহটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে
না । পরবর্তীতে আবিস্কৃত হলো এখানে
ঠিকই একটি গ্রহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল,কিন্তু কোনো কারণে সেটা সম্পন্ন হতে পারে নি । যে যে গ্রহের সমন্বয়ে গ্রহটি গঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝের অঞ্চল জুড়ে । এই অঞ্চলের বস্তু গুলোকে আমরা গ্রহাণুপুঞ্জ বলে
জানি । অর্থাৎ গ্রহাণুপুঞ্জ
হল,এরা একত্রে একটি গ্রহ গঠন করার কথা ছিল ।
ছবি: থিংলিংক
১৮৪৬ সালের দিকে নেপচুন গ্রহ আবিষ্কৃত হয় । নেপচুনের আগের গ্রহ ইউরেনাস । ইউরেনাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সেখানে কিছু অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করেন । পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের মাধ্যমে সেগুলো বিশ্লেষণ
করে বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন এর বাইরে আর একটি গ্রহ থাকতে পারে । সেই গ্রহটি হচ্ছে নেপচুন। পরবর্তীতে নেপচুনের গতিপথেও কিছু অসামঞ্জস্য
খুঁজে পায় বিজ্ঞানীরা । ধরে নেয় এর বাইরে কোনো একটি গ্রহ আছে যেটি তার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের মাধ্যমে নেপচুনের
গতিপথকে প্রভাবিত করছে ।
কিন্তু কোথায় সেই গ্রহ ? দিনের পর দিন খোঁজা হয়, কিন্তু ধরা দেয় না । বিজ্ঞানীরা এর নাম দিলেন ‘প্লানেট এক্স'বা অজানা গ্রহ । গ্রহ খোঁজার জন্য যিনি অত্যান্ত গুরুত্ব
দিয়ে মাঠে নামেন তাঁর নাম হচ্ছে পার্সিভাল লোভেল । খুব সম্পদশালী ছিলেন । অনেক অর্থ ব্যয় করে আরিজোনায় ‘লোভেল অবজারভেটরি' নামে একটি মানমন্দির তৈরি করেন । ১৮৯৪ সালে সম্ভাব্য গ্রহটি খুঁজে পাওয়া জন্য
ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেন সেখানে ।
কিন্তু বিধি বাম । অনেক দিন খোঁজাখুঁজির পরেও সেই গ্রহ টি খুঁজে পাওয়া যায় নি
। ১৯১৬ সালে পার্সিভালের মৃত্যুর
পর্যন্ত বিশেষ এই গ্রহ অনুসন্ধানের কাজ অব্যাহত চলছিল । তার মৃত্যুর পর এই কাজে ভাটা পরে যায় ।
ছবিঃ পার্সিভাল লোভেল,প্লুটোর আবিস্কারের পেছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ।
অনেক দিন পর একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এই কাজকে বেগমান করে । লোভেল অবজারভেটরির পরিচালকের কাছে একদিন আকাশপটের
চিত্র সম্বলিত একটি চিঠি আসে । চিঠিটি পাঠিয়েছেন একজন তরুণ,যার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো লেখাপড়া নেই । বেশি লেখাপড়া করতে পারে নি এমন তরুণের আকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা
দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাকে ডেকে এনে একটি চাকুরী দিয়ে দেন । চাকুরীতে কাজ হলো আকাশের ছবি তুলে তুলে প্লুটো গ্রহকে অনুসন্ধান
করা । তরুণের নাম ক্লাইড
টমবো (Clyde Tombaugh) । কেন এবং কিভাবে এখানে চিঠি পাঠালো সে গল্প ও বেশ ঘটনা বহুল । ছোটবেলা থেকেই টমবোর জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহ
ছিল । এর জন্য পরিবেশও
পেয়েছিল ইতিবাচক । চাচার একটি টেলিস্কোপ ছিলো । সেটি দিয়ে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন । এক সময় নিজেই টেলিস্কোপ তৈরি করার কৌশল রপ্ত
করে নিলেন । ১৯২৮ সালে
একটি ৯ ইঞ্চি রিফ্লেকটর টেলিস্কোপ তৈরি করেন । এর আগে বানানো টেলিস্কোপ গুলো এতোটা নিখুঁত ছিল না । সে তুলনায় এটি বেশ নিখুঁত হয়েছে । আকাশপট দেখাও যায় পরিষ্কার । সে বছর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার কথা
ছিল । সাবজেক্ট
ও ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান । কিন্তু ভাগ্য ইতিবাচক ছিল না তার । এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শিলাবৃষ্টিতে পরিবারের সকল ফসল ধ্বংস
হয়ে গেল । এখনকার আমেরিকা
আর তখনকার আমেরিকার মাঝে বিস্তর পার্থক্য । সে সময় সকল ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে না অনাহারে মরে যাওয়া। এমন অবস্থায় তার পরিবারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের
খরচ জোগানো সম্ভব ছিলনা । মন খারাপ করে তিনি থেকে রইলেন সেখানে এবং কৃষি কাজে মন দিয়ে পরিবারের উন্নয়ন করার কাজে মনঃস্থ হলেন
। জ্যোতির্বিজ্ঞান
নিয়ে পড়তে পারেন নি তো কি হয়েছে,আকাশ প্রেমী মনটা তখনো রয়ে গিয়েছিল । কাজ শেষ করে রাতের বেলায় টেলিস্কোপ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আকাশে
। শখের বসেই পর্যবেক্ষণ
করতে লাগলেন বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহ । পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গ্রহ দুটির নিখুঁত চিত্র একে সেগুলো পাঠিয়ে
দিলেন লোভেল অবজারভেটরিতে । অবজারভেটরির পরিচালক তার প্রতিভা ধরতে পারেন এবং ডেকে এনে আকাশ পর্যবেক্ষণ করার
চাকুরিতে বসিয়ে দেন ।
ক্লাইড টমবো,তিনিই প্লুটো গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন । ছবি : দ্যা টেলিগ্রাফ।
কোনো মানুষ যখন তার শখের ও পছন্দের কাজটি চাকুরী হিসেবে পায়
তখন কাজটি দেখতে তখন যত কঠিনই মনে হোক না কেন তার কাছে সেটি আনন্দদায়ক । টমবোর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য । কারণ সূর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে এমন
কোনো গ্রহ কে খুঁজে বের করা সহজ কথা নয় । আকাশের সম্ভাব্য যে যে অবস্থানে গ্রহটি থাকার কথা সে অংশগুলোর
ছবি তুলে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে তা বের করা । মনে হতে পারে এ আর এমন কঠিন কি ? ছবি তোলাই তো । কিন্তু যখন দেখা যাবে আকাশের ঐ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বিন্দু ধরে
ছবি তুলতে হবে তখন অবশ্যই সেটি কঠিন কাজের মাঝে পড়ে । পরিশ্রম সাধ্য কাজ হলেও টমবো আনন্দের সাথেই তা
করতে থাকে । ১৯৩০ সালের
দিকে তিনি তার পরিশ্রমের ফল পেলেন । আকাশের একটা অংশে এমন একটা বিন্দুর দেখা পেলেন যেটি তার অবস্থান
থেকে সরে যাচ্ছে । এটিই নতুন গ্রহ প্লুটো । গ্রহ আবিষ্কারের খবর যখন প্রকাশ করা হল তখন সারা দেশে মোটামুটি একটা আলোড়ন পড়ে
গেল । ২৩ বা ২৪ বছরের এক তরুণ আস্ত
একটি গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছে এই খবরে সারাদেশে তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন । একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্কলারশিপ প্রদানের
মাধ্যমে লেখাপড়ারও সুযোগ করে দিলো ।
১৯৩০ সালের জানুয়ারির ২৩ ও ৩০ তারিখে প্লুটোর অবস্থান । এই ছবি থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল প্লুটো গ্রহ। ছবি: ভিন্টেজ স্পেস ।
নামকরণ
পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গেছে প্লুটো গ্রহের আবিষ্কার । শুধু আমেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে গেছে এর আমেজ । নতুন গ্রহটির তো একটা নাম দেয়া দরকার । সে উদ্দেশ্যে নাম আহ্বান করা হলে প্রায় এক হাজারের
চেয়েও বেশি নাম জমা হয় । অনেক নাম আসে
তাদের হাতে । সবগুলো
নাম যাচাই বাছাই করে এগারো বছর বয়সী এক স্কুল বালিকার নাম গ্রহণ করা হয় । তার প্রস্তাবিত নাম ছিল প্লুটো । কারণ চিরায়ত পুরাণে প্লুটো হচ্ছে Underworld বা অন্ধকার রাজ্যের দেবতা । অন্যদিকে প্লুটোও সবসময় অন্ধকারে থাকে । সূর্য থেকে এত দূরে এর অবস্থান যে সেখানে পর্যাপ্ত
আলো পৌঁছায় না বললেই চলে । সে হিসেবে নামকরণ সার্থক ।
ভেনেটিয়া বার্নে,তিনি এগারো বছর বয়সে প্লুটো গ্রহের নামকরণ করেছিলেন । ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন ।
ছবি :উইকিমিডিয়া কমন্স ।
ভেনেটিয়া নামক স্কুল বালকটির ছোটবেলা থেকেই পৌরাণিক গল্পের প্রতি
আগ্রহ ছিল । তার দাদা
ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান । দাদার সাথে কথা বলেই তিনি নামটি প্রস্তাব করেছিলেন ।
কেন প্লুটো গ্রহের তালিকার বাইরে
গ্রহটি আবিষ্কারের পর ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথ সংক্রান্ত সমস্যার
হয়তো সমাধান হয়েছে, কিন্তু সাথে সাথে আরও অনেকগুলো নতুন সমস্যার জন্মও হয়েছে । যেমন এটি আকারে অনেক ছোট । এর ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৫ ভাগের এক ভাগ । ভরও অনেক কম,পৃথিবীর ভরের ৫০০ ভাগের এক ভাগ । এর কক্ষপথ ও স্বাভাবিক নয়,সূর্যের চারপাশে আবর্তনের এক পর্যায়ে নেপচুনের কক্ষপথ ভেদ করে ভেতরে চলে আসে
। সৌরজগতের বাইরের
দিকের গ্রহগুলো গ্যাসীয়, কিন্তু এটি পাথুরে
। অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি
একটি সমতলে অবস্থান করছে কিন্তু এর কক্ষপথ কিছুটা হেলে আছে । এর মাঝে প্লুটোর একটি উপগ্রহও আবিষ্কৃত হয় । সাধারণত কোনো গ্রহের উপগ্রহ গুলো অনেক ছোট হয়
এবং গ্রহের শক্তিশালী আকর্ষনের প্রভাবে এরা গ্রহের চারপাশে ঘুরে । কিন্তু প্লুটোর বেলায় হয়েছে অন্যটা । প্লুটোর উপগ্রহটি প্লুটোর আকারের প্রায় অর্ধেক, যা উপগ্রহ হিসেবে তুলনামূলক ভাবে অনেক বড় । উপগ্রহ যদি আকারের দিক থেকে গ্রহের আকারের অর্ধেক
হয়ে যায়, তাহলে তো সেটি গ্রহের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাবে
। আকারে বড় হওয়ার
কারণে অবাধ্য আচরণ করবে । মূল গ্রহের প্রভাব না মেনে নিজেই একটা প্রভাব তৈরি করতে চাইবে । এমন হয়ে থাকলে সেটা গ্রহের মান সম্মানকেই প্রশ্নের
মুখে ফেলে দিবে ।
প্লুটো এবং তার উপগ্রহ ক্যারন । এরা উভয়ে উভয়ের আকর্ষণ দ্বারা প্রভাবিত । ছবি:ডেইলি গ্যালাক্সি ।
প্লুটোর গ্রহত্ব নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় ২০০৫ সালে
। বিজ্ঞানীরা প্লুটোর
সীমানার বাইরে একটি বস্তুর দেখা পান,যার ভর প্লুটোর ভরের চেয়েও বেশি । এর নাম রাখা হয় এরিস । আবিষ্কারের পরপর নাসা কতৃপক্ষ একে দশম গ্রহ হিসেবে ঘোষণা দেয়
। কিন্তু পরবর্তীতে
ঐ এলাকায় এরকম আরও কিছু বস্তু খুঁজে পাওয়াতে গ্রহের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় । বস্তুদেরকে এভাবে গণহারে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে
ঐ কক্ষপথের আশেপাশে অনেক গুলো গ্রহ হয়ে যাবে, যা শুধু ঝামেলাই বাড়াবে । এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়ে যান এবং সম্মেলনের মাধ্যমে
গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন । ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়ন
(IAU) এর এই সম্মেলনে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় । এখানে প্রথমে বিজ্ঞানীদের নিয়ে ভোটাভুটি করা
হয় । একটি অপারেশন হচ্ছে
এরিস ও সেরেস ( সবচেয়ে বড় গ্রহাণু) সব গ্রহ হবে মোট বারোটি । প্লুটোও থাকবে গ্রহের তালিকায় । যেহেতু তাদের ভর প্লুটোর চেয়ে বেশি বা প্লুটোর
কাছাকাছি তাই প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে ধরে নিলে তাদেরকে কেন নেয়া হবে না ? আরেকটি অপারেশন হচ্ছে সৌরজগতের যে যে বস্তু গুলো বেশি পরিচিত সেগুলো
গ্রহের পরিচয় পাবে । তাহলে প্লুটো সহ মোট গ্রহ হবে ৯ টি । প্লুটোর চেয়েও ভারী অন্যান্য বস্তু দুটি তালিকা থেকে বাদ যাবে
। এই সংজ্ঞা অবশ্যই
যুক্তিসজ্ঞত নয় । তৃতীয় অপারেশন হচ্ছে যৌক্তিক সংজ্ঞার ভেতরে পড়লে কোনো বস্তু গ্রহ
বলে বিবেচিত হবে । এর বাইরে হলে নয় । এই হিসেবে মোট গ্রহ হবে ৮টি । প্লুটো যাবে বাদ । সাধারণ গ্রহাণু থেকে বড় কিন্তু স্বাভাবিক গ্রহ থেকে ছোট, এ ধরনের বস্তুর জন্য বামন গ্রহ নামে আলাদা একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় । সেই হিসেবে প্লুটো, সেরেস,এরিস বামন গ্রহ হিসেবে বিবেচ্য হবে
।
২০০৬ সালের ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়নের সাধারণ সম্মেলন। এখানে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় । ছবি :IAU
ভোটাভুটিতে বিজ্ঞানীরা শেষোক্তটিকেই বেচে নিলেন । গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটো বাদ । এই সম্মেলন যদি সাধারণ মানুষদের নিয়ে করা হতো
তাহলে তারা আবেগকেই প্রাধান্য দিতো বেশি । কিন্তু বিজ্ঞানীদের নিয়ে করাতে সেখানে যৌক্তিক অবস্থানটি জয়ী
হয়েছে ।
গ্রহ হবার শর্ত
ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিয়ন কতৃক নির্ধারিত গ্রহ হবার
শর্ত গুলো হচ্ছে –
1. সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে । (প্লুটো এই শর্তে উত্তীর্ণ) ।
2. যথেষ্ট ভর থাকতে হবে যেন তার অভিকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে নিজেকে
মোটামুটি গোলাকার আকৃতি ধারণ করতে পারে । (প্লুটো এই শর্তে অনুত্তীর্ণ) ।
3. কক্ষপথে ঘোরার সময় তার আসেপাশে শক্তিশালী প্রভাব রাখতে হবে যেন
আসেপাশের জঞ্জাল বস্তুগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে । (এখানেও প্লুটো অনুত্তীর্ণ) ।
শেষ দুই শর্ত পূরণ করতে পারে নি বলে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা
থেকে বাদ দেয়া হয়েছে । খেয়াল করলে দেখা যাবে সকল গ্রহই গোল হয় । কোনো গ্রহই পিরামিড, সিলিন্ডার কিংবা ঘনকের মতো হয় না । বস্তু যখন খুব বেশি ভারী হয়ে যায়, তখন তার আকর্ষণের শক্তির তুলনায় গ্রহের উপাদান গুলো প্রবাহী বা
ফ্লুইডের মতো হয়ে যায় । স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পৃথিবীর গাঠনিক উপাদানকে কঠিন পদার্থ বলে মনে হলেও পৃথিবীর
শক্তিশালী আকর্ষণ সেগুলোকে স্থানচ্যুত করতে পারে । প্রকৃতির সকল বস্তুর ধর্মই হচ্ছে গোলাকৃতি ধারণ করা । মগ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিলে দেখা যাবে সেই পানি
অনেকগুলো গোলাকার ফোটা তৈরি করেছে । যাকে বলা হয় পৃষ্টটান । গ্রহগুলোও এই ধর্মের জন্য গোলাকৃতি ধারণ করে
। কিন্তু প্লুটোর
মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ ভর নেই যা দিয়ে নিজের গাঠনিক উপাদানকে নেড়েচেড়ে অন্য যেকোনো আকৃতি
থেকে পালটে গোলাকৃতি ধারণ করতে পারবে । অন্যান্য গ্রহ যখন তাদের কক্ষপথে ঘোরে তখন মহাকর্ষীয় আকর্ষণের
মাধ্যমে আশেপাশের ক্ষুদ্র বস্তু গুলোকে নিজের দিকে টেনে নেয় । ফলে কক্ষপথ হয়ে যায় জঞ্জাল মুক্ত । প্লুটো এই কাজটি করতে পারেনি । যথেষ্ট শক্তিশালী প্রভাব নেই বলে তার কক্ষপথের
আশেপাশে জঞ্জাল রয়েই গেছে । এতসব দিক বিবেচনা করে প্লুটোকে
সতর্কতার সাথেই গ্রহের তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে । ছোটবেলায় আমরা বই পুস্তকে প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে
পড়েছিলাম । এখন পড়তে
হবে প্লুটো একটি বামন গ্রহ মাত্র ।
মন খারাপের গল্প
এতদিনের প্রতিষ্ঠিত ও এতো চমৎকার নামধারী একটি গ্রহের গ্রহত্ব
ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে -এটা মানতে পারেনি
আমেরিকার মানুষজন । এদের দাবী হচ্ছে -আকৃতি কোনো ব্যাপার
না, সারা জীবন একে আমরা গ্রহ হিসেবে জেনে এসেছি তাই একে গ্রহের
অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া হোক । কেউ কেউ বলেছে -সকল আকৃতি, সকল আকার এবং সকল ধরণের কক্ষপথকেই আমরা সাপোর্ট
করি । তাই প্লুটো
যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তাকে গ্রহের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হোক । আবার কেউ কেউ পোস্টারে লিখেছে – এখন প্লুটোকে সরানো হয়েছে, আপনাদের পরবর্তী
টার্গেট কি নেপচুন আর ইউরেনাস কে সরানো ?
সাধারণত বিজ্ঞান সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোর দাবিদাওয়া আন্দোলনের
মাধ্যমে আদায় করা যায় না । আমেরিকানরা এটাই করেছে । বাংলাদেশেও এমন হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকে ‘ বাকের ভাইয়ের ‘ যেন ফাঁসি না হয় সেজন্য মিছিলে
নেমেছিল মানুষ । এধরণের ব্যাপারগুলো আবেগের নারী ধরে টান দেয়,তাই হয়তোবা মানুষজন আবেগের বশবর্তী হয়ে নেমে যায় রাস্তায় । বিজ্ঞানের
ধর্মই হচ্ছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলা । যৌক্তিক পরিবর্তনকে মেনে নেওয়াই হচ্ছে সত্যিকার
বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক । দীর্ঘদিন ধরে কোনোকিছুকে বিশেষ পরিচয়ে চিনলে তার প্রতি মায়া তৈরি হবেই । এই পরিচয়ে পরিবর্তন আসলে মায়া এবং আবেগে টান
দেবেই । কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে
আবেগ এবং মায়াকে বাক্সবন্দী করে পরিবর্তন কে মেনে নিতে হবে । প্লুটোর এ গল্প আমাদেরকে এটাই শিক্ষা দেয় ।
তথ্যসূত্রঃ
1.
আরো
একটুখানি বিজ্ঞান, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, কাকনি প্রকাশনী ।
2.
মহাকাশের
কথা, ফারসীম মান্নান মোহাম্মাদী, অনুপম প্রকাশনী ।
3.
Universetoday.com
4.
Vintagespace.wordpress.com
5.
Wikipedia.org
0 মন্তব্যসমূহ