ভয়েজার নিয়ে লিখেছেন উম্মে ইফফাত জাহান
আমাদের
সৌরমণ্ডলের বিস্তৃতি ব্যাপক। এই ব্যাপকতা পৃথিবীতে বসে সম্পূর্ণরুপে উদঘাটন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব প্রায়। তাই এই বিস্তৃতি উদঘাটনের
লক্ষ্যে নাসার একদল বিজ্ঞানী ভয়েজার- ১
ও ভয়েজার - ২
স্পেসক্রাফট তৈরি করলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, সৌরমণ্ডলের সকল অজানা
তথ্য জানা । যার ফলস্বরূপ আমরা আজ পৃথিবীতে বসেই সৌরমণ্ডলের সকল তথ্য পেয়ে আসছি
।
ভয়েজা-১ এবং
ভয়েজার-২ এর মধ্যে নাসা সর্বপ্রথম ২০ আগষ্ট, ১৯৭৭ সালে ভয়েজার-২২ কে
মহাশূন্যে পাঠায়। অতঃপর ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে ভয়েজার-১
কে পাঠানো হয়। কিন্তু ভয়েজার-১
এর গতি ভয়েজার-২ এর তুলনায় বেশি হওয়ায় তা
ডিসেম্বরের মধ্যেই ভয়েজার-২ কে ছাড়িয়ে আগে চলে যায়। এই মিশনটি
মানব ইতিহাসের এক মহান মিশন। দীর্ঘ ৫ বছরের পরিকল্পনা এবং বিজ্ঞানীদের
অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রায় ৬৫ হাজারেরও ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে
এই স্পেসক্রাফট দুটি। যেগুলোর পিছনে ছিল অগণিত ম্যাথমেটিক্স
আর ক্যালকুলেশন । কারণ লক্ষ্য ছিল মহাশূন্যের দীর্ঘ
পথ অতিক্রম করে জয়ী হতে হবে এদের। জেনে নেওয়া যাক এই রহস্যময় দুই সৃষ্টির সম্পর্কে অজানা তথ্য।
১৯৭২ সাল
নাসার বিজ্ঞানীরা তখন ভয়েজার-১ নিয়ে কাজ করছিলেন। এটিকে
প্রেরণ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের মহাশূন্যের বিষয়ে অধিক থেকে অধিকতর তথ্য সরবরাহ করা। কারণ
ঐ সময় আমরা শুধুমাত্র টেলিস্কোপর সাহায্যে
পৃথিবী থেকে বাইরের গ্রহ গুলোকে দেখতে পেতাম যা যথেষ্ট ছিল না। গ্রহ গুলো কিভাবে
তৈরি হলো,
দেখতে কেমন, কিভাবে ঘুরে এসব তথ্য জানার জন্য গ্রহ গুলোকে আরও কাছ থেকে
দেখার প্রয়োজন ছিল। তবে ঐ সময় এদের পাঠানোর কেবল মাত্র
একটি নয়,
আরও একটি কারণ ছিল। সে সময় আমাদের সৌরমণ্ডলের সব গ্রহ একটি অপরটি
থেকে নিদিষ্ট দূরত্বে এমনভাবে অবস্থান
করছিল যে, পর্যায়ক্রমে গ্রহগুলোকে অধ্যয়ন করা ভয়েজারের পক্ষে সহজ
ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের সৌরমণ্ডলের গ্রহ গুলোর এমন পর্যায়ক্রমিক অবস্থান ১৭৫
বছরে একবার হয়ে থাকে। তাই সে সময়টিকে আদর্শ সময় ধরে তারা মিশনটি হাতে নেন। আর
প্রায় ১ কিলিয়নের থেকে অধিক অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা হলো এই ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২
নামক স্পেসক্রাফট দুটিকে।
![]() |
ভয়েজারের গবেষনাগার |
কিন্তু
বিজ্ঞানীরা জানতেন একটা সময় ভয়েজার আমাদের সোলার সিস্টেম থেকে অনেক দূরে চলে যাবে।
আর বিজ্ঞানীরা বলেন হয়ত, আমাদের
মতই বা আমাদের থেকে উন্নত কোনো সভ্যতা থাকলেও থাকতে পারে। মহাশূন্যে তাই যদি
আমরা তাদের উদ্দেশ্যে কোন তথ্য বা বার্তা ভয়েজারের মাধ্যমে দিয়ে দেই তাহলে তারা জানতে পারবে পৃথিবী নামক গ্রহে মানব
সভ্যতা বলে কিছু আছে। নিজেদের পরিচয় তাদের কাছে তুলে ধরার এই চিন্তা ছিল সেই কালের
মহান বিজ্ঞানী কার্লস হারগেনের। তিনি ঐ
শতাব্দীর এক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি মনে করতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমরা একা নই, আমাদের
বাইরেও আরও কিছু সভ্যতা আছে। আর তাঁর এই ধারণা থেকে তৈরি করা হয় একটি " গোল্ডেন
রেকর্ডার "। এই গোল্ডেন রেকর্ডের মধ্যে মানবজাতির তথ্য পাঠানোর ধারণা
দেয়। ঐ সময়ের আর একজন বিজ্ঞানী ফ্রেড রেক। তিনি বলেন, অ্যালুমিনিয়ামের
সাধারণ প্লেটের পরিবর্তে একই সমান ও একই সাইজের ফোনোগ্রাফ রেকর্ড পাঠানো হোক। আর সেই
সাথে এটাকে কিভাবে প্লে করতে হবে সেরকম নির্দেশনা
চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে দিয়ে দেয়া হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ডার। অভিনব
বিষয় হল এর ভিতর ছিল পৃথিবীর ৫৫ টি ভাষা ১১৫ টি ছবি ও সবচেয়ে মজাদার বিষয় হল এর
মধ্যে সংগীতও জুড়ে দেওয়া হয়।
মানব
সভ্যতা যদি বিলীনও হয়ে যায়, এ রেকর্ড আমাদের চিহ্ন ধরে রাখবে। আর এই আশাতে গোল্ডেন
রেকর্ডটি স্পেস-প্রোবে যুক্ত করা হয়।
![]() |
গোল্ডেন রেকর্ডার |
এবার আসা যাক ভয়েজারের যাত্রাপথে। জানুয়ারি ১৯৭৯ আসতে আসতে ভয়েজার-১ তার প্রথম গ্রহ জুপিটারে পৌঁছে যায়। কিন্তু ভয়েজার-২ এর পক্ষে তখনো জুপিটারে পৌঁছাতে আরও চার মাস লাগবে। ভয়েজার-১ ইতোমধ্যে গ্রহের ছবি পাঠানো শুরু করে যা ছিল আগের থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু কালার ফিল্টার না থাকায় সেগুলো সাদা কালো ছিল। পরে কালার ফিল্টার লাগিয়ে এগুলো রঙ্গিন করা হয়। ভয়েজার-১ আমাদেরকে জুপিটারের ভিতরে চলতে থাকা এক ডজনের থেকেও অধিক ঝড়কে অধ্যয়ন করতে সাহায্য করে। তাছাড়া ভয়েজার-১ হল সেই প্রথম স্পেস-প্রোব যা জুপিটারের একটি চাঁদের ভেতর হওয়া আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ অধ্যয়ন করেছিল। ভয়েজার-১ জুপিটারের অনেক উপগ্রহের ছবি পৃথিবীতে পাঠায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি উপগ্রহ Ganymede এবং Calisto ছিল। কিন্তু ভয়েজার এরপরে আরও বড় সন্ধান দেয়। জুপিটারের আরও দুটি চাঁদ ইউরোপা ও আয়ো । ইউরোপা ছিল বরফের মোটা চাঁদরে ঢাকা যার নিচে তরল পানি থাকার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে আয়োই হলো সেই উপগ্রহ যার ভেতরে পৃথিবীর থেকেও বড়, শক্তিশালী ও সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মজুদ আছে। ভয়ের বিষয় ছিল ভয়েজার জুপিটারকে অধ্যায়নকালে এর কঠিন ম্যাগনেটিক প্রভাবের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ছিল। কিন্তু তা যে কোনো ভাবে বেঁচে ফিরে আসে। এরপর ভয়েজার মিশন ছিল শনি গ্রহ । ১ বছর পর তা শনিতে পৌঁছায় আর আমাদেরকে শনি সম্পর্কে ও এর বলয় অজানা অনেক তথ্য দেয়। ভয়েজারই আমাদেরকে শনির চাঁদ টাইটানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা নাইট্রোজেনে ভরা এবং এর ভূমিতে মিথেনের নদী হতে পারে । ভয়েজার-১ এর কাজ এখানেই শেষ হয়।
শুরু হয়
ভয়েজার-২ এর কাজ। ভয়েজার-২ কে শনির অনেক কাছ দিয়ে ইউরেনাসের দিকে যেতে হয়। জানুয়ারী ১৯৮৬ তে ভয়েজার-২
ইউরেনাসে পৌছায়। ভয়েজার-২ এর মাধ্যমেই পৃথিবী সর্বপ্রথম ইউরেনাস কে দেখে। ভয়েজার
ইউরেনাসের ৮-১০ টি ছোট চাঁদের খোঁজ, এ গ্রহের রেডিয়েশন বেল্টের খোঁজ করেছে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো ভয়েজার-২ই সর্বপ্রথম স্পেস-প্রোব যা ইউরেনাসের সবচেয়ে ছোট ও
কাছের চাঁদ ম্যারেন্ডার তথ্য আমাদের দেয়। ইউরেনাসকে বিদায় দিয়ে আগষ্ট ১৯৮৯ এ ভয়েজার-২ নেপচুনে পৌঁছায়। অবাক করা
বিষয় হলো, নেপচুনকে পৃথিবী থেকে দেখা সবচেয়ে ছোট গ্রহ মনে হয়। ভয়েজারের
সাহায্যে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান এর ভিতর থাকা অনেক বড় একটি দাগ। আমাদের সোলার
সিস্টেমের সর্বশেষ গ্রহ ছিল এটি। ভয়েজার এগিয়ে চলে ও দেখা পায় নেপচুনের চাঁদ
টাইট্রানকে যার অর্ধেক নাইট্রোজেনের বরফে ঢাকা।
এভাবে
ভয়েজার আমাদেরকে ৪ টি গ্রহ ও তাদের চাঁদের সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করল। কিন্তু এতেই শেষ না, ভয়েজার
এগিয়ে যায়। এই স্পেস-প্রোব দুটি এখন আমাদের
সৌরমণ্ডলকে পার করে অনেকটা দূরে চলে গেছে। ভয়েজার-১ এখন
পৃথিবী থেকে ১২০.৩৯ আলোক বর্ষ দূরত্বে আছে। ভয়েজারের বর্তমান মিশন হলো Interstellar Space. এটি Interstellar
Space এ প্রবেশ করে ফেলেছে। বর্তমানে
এর পাওয়ার ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। অবাক হতে পারে সবাই এটা ভেবে যে, মহাকাশযান
দুটি কিভাবে এতো দূরে যাত্রা করছে। এতে মূলত হাইড্রোজিন নামক জ্বালানী রয়েছে,
যা সহজলভ্য। এতে যা জ্বালানী আছে তা ২০৪০ সাল পর্যন্ত কাজ করবে। সত্যি
বলতে এর বাস্তবিক সীমা তো এই মানটির মধ্যে থাকা দ্বিতীয় আরও একটি জ্বালানি নির্ধারণ করে থাকে। সেটি
হলো প্লাটিনাম-২৩৮। এটি হলো
সেই জ্বালানি যেটি এর উপকরণ ও সঞ্চার ব্যবস্থাকে ঠিক রাখে। এর রেডিও
এক্টিভ ফিউশন থেকে যে হিট বের হয় সেটার সাহায্যেই হিটি, ইলেক্ট্রিক,
জেনারেটর কাজ করে।
এখন
ভয়েজারে ৫০% থেকেও কম বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো কথা হলো মহাশূন্যে কোনো
ঘর্ষণ বল নেই। তাই ভয়েজারের হাইড্রোজিন শেষ হয়ে গেলেও তা এগিয়ে যাবে । যদি এটি
ক্রাশ না হয়।
পরিশেষে
বলা যায়,
আমাদের অনেকের যখন জন্ম হয়নি তখন থেকে মহাকাশযান দুটি কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে। আমাদের
আয়ত্বের বাইরে এটি চলে গেলেও মানব সভ্যতার
প্রতীকী হিসেবে এটি কাজ করবে। তাই বলা যায়, মহাশূন্যের রহস্য উদঘাটনে এই মহান স্পেস-প্রোব দুটির অপরিসীম
ভূমিকা মানব ইতিহাসে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইতিহাস হয়ে থাকবে ।
লিখেছেন
উম্মে
ইফফাত জাহান
উচ্চ
মাধ্যমিক, বিজ্ঞান বিভাগ
কাপাসগোলা
সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম
0 মন্তব্যসমূহ